
জীবনের দীর্ঘ সময় লাশ টানা হাশেম সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে এখন নিজেই জীবন্ত লাশের মত অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন।
নাটোরের লালপুর উপজেলার কচুয়া কাগিরপাড়া গ্রামের মৃত আবু বক্কর প্রামানিক ও মোছা. শকেজানের ছেলে মো. হাশেম আলীকে (৬৫) ‘লাশ টানা হাশেম’ নামে সবাই চেনেন। তিনি দীর্ঘ ৪০ বছরে লালপুর, বাগাতিপাড়া ও বড়াইগ্রাম (তিন) থানার পাঁচ হাজারেরও বেশি লাশ টেনেছেন।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) সকালে হাশেম আলী তার জীবন কাহিনিতে বলেন, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে লালপুর থানার মরদেহ নাটোর মর্গে আনা-নেওয়া করেছেন। যৌবন কালে বিয়ের যৌতুকের টাকায় একটি পায়ে চালানো ভ্যানগাড়ি কিনে এই কাজ শুরু করেন তিনি। পরে কুষ্টিয়া থেকে ইঞ্জিন চালিত ভ্যান কিনে কুড়ি বছরের বেশি সময় লাশ টেনেছেন। লাশ টানা ছাড়াও মামলা জনিত কবর থেকে লাশ উত্তোলন ও দাফন করেছেন তিনি। ময়না তদন্তের জন্য ডাক্তার-ডোমের সাথে লাশ কাটা ও লাশের বিবরণ লিখতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্টদের।
হাশেম আলী তাঁর জীবন গল্পে বলেন, ২৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছেন। বিয়ের ১৪ দিন পর থেকেই লালপুর, বড়াইগ্রাম আর বাগাতিপাড়া থানা পুলিশের ডাকে মরদেহ বহনের কাজ শুরু করেন। যৌবনের শুরুতে হাশেম স্থানীয় চায়ের দোকানগুলোতে খড়ি (জ্বালানী) বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রায় ৪০ বছর আগে একদিন লালপুর বাজারে খড়ি বিক্রি করতে এসে দেখেন ঘোড়ার গাড়ি (টমটম) চালকদের লালপুর থানার এক পুলিশ অফিসার নাটোর মর্গে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য বলছেন। কিন্তু ঘোড়া গাড়ির চালকরা এতে রাজি না হয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের ধারণা লাশ টানলে ঘোড়া মারা যাবে। অবশেষে এক ঘোড়ার গাড়ির চালক ৭ শ টাকায় লাশ নাটোর মর্গে নিতে রাজি হন। তখন তিনি ভাবলেন, তিনি সারাদিন খড়ি বিক্রি করে ৩০-৪০ টাকা উপার্জন করেন। আর একটি লাশ টানলে পাবেন ৭০০ টাকা। এ চিন্তা থেকেই হাশেম আলী উপজেলার বিলশলিয়া গ্রামের আব্দুল জব্বারের মেয়ে বুলু খাতুনকে ৬ শ টাকা যৌতুক নিয়ে বিয়ে করেন। যৌতুকের ওই টাকা দিয়ে একটি ভ্যান গাড়ি কিনে উপার্জন শুরু করেন। একদিন রাতে লালপুর থেকে গোপালপুর যাওয়ার পথে শিমুলতলা নামক স্থানে দেখলেন, একটি বেওয়ারিশ লাশ মর্গে পাঠানোর জন্য পুলিশ বিভিন্ন ভ্যান চালকদের অনুরোধ করছেন। কিন্তু এতে কেউ রাজি হচ্ছেন না।
এমতাবস্থায় সামনে পেয়ে পুলিশ হাশেম আলীকে প্রস্তাব দিলেন। তিনি কোন চিন্তা না করেই তার স্বপ্ন বাস্তব করতে রাজি হয়ে নাটোর মর্গে লাশ নিয়ে যান। প্রথম লাশ টানার জন্য খরচ পান ৬ শ টাকা। সেই থেকে দীর্ঘ ৪০ বছরে ৫ হাজারেরও বেশি লাশ টেনেছেন। লাশ টানার জন্য সরকারি কোন বরাদ্দ পাননি। মৃতের স্বজনদের কাছ থেকে সামান্য টাকা পেয়েছেন। বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে থানা থেকেই কিছু টাকা দেওয়া হতো। অন্য সময় মাঠে কাজ করে সংসারে জীবন জীবিকা চালিয়েছেন লাশ টানা হাশেম আলী।
তিন মেয়ে ও দুই ছেলের জনক হাসেম লাশ টানার কারণে কোন যাত্রী তার গাড়িতে উঠতো না। ৬ বছর সমাজ থেকে ‘একঘরে’ হয়ে ছিলেন বলে জানান তিনি। অনেক সময় পরিবারের সদস্যরাও তার সাথে থাকেননি। পরিবারের অন্য সদস্যরা তার হাতে খাবার পর্যন্ত খেতেন না। নিজের পরিধেয় পোশাক-কাপড় নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয়েছে। শুধুমাত্র এই পেশার কারণে তার মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায়নি। মেয়েদের নিয়ে হতাশায় দিন কাটিয়েছেন একটি সময়।
এরপর তিনি তার দুর্বিষহ জীবনের শুরুর কথা বলতে শুরু করেন। ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেশী এক ভাতিজার মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন হাশেম আলী। ওই ভাতিজার নিজেরও ভ্যান গাড়ি রয়েছে। তাই তিনি হাশেমের ভ্যান চালাচ্ছিলেন। আর হাসেম ভ্যানের ডান পাশে বসেছিলেন।বাগাতিপাড়া উপজেলার মালঞ্চি বাজার পার হওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে ইঞ্জিনচালিত একটি ভ্যান সজোরে তার পায়ে ধাক্কা দেয়। হঠাৎ ধাক্কায় ভ্যানটি উল্টে গেলে ওই গাড়ির সামনের দুটি রড, ও লাইটসহ তার পায়ের মাংসের ভেতর ঢুকে তার পায়ের হাড় ভেঙে যায়।
স্থানীয়রা উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসা শেষে প্রথমে তাকে রাজশাহী এবং পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর পরে সেখানে পর পর দুইবার অস্ত্রোপচার করতে তাঁর ১৮ কাঠা জমি ও বাড়িতে পালন করা দুটি গরুর বাছুর বিক্রি করতে হয়েছে। এর পরে ২০ দিন পর তার আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা, সংসারের খরচের পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের টাকা জোগাড়ে দিশেহারা হয়ে যান হাসেম আলী। এখন শুধুমাত্র বসতবাড়ির ৩ কাঠা জমি অবশিষ্ট রয়েছে।
হাশেম আলী বলেন, তার দুই ছেলে আর তিন মেয়ে। সবারই বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে শুকুর আলী আর আব্দুল গাফফার ভ্যান চালান। তাদের সংসার আলাদা। স্ত্রীর এক চোখ অপারেশনের পর অনেক দিন থেকেই অসুস্থ। এখন এক চোখে দেখেন। দুর্ঘটনার পর মাঝে মাঝে দুই ছেলে কিছু সহযোগিতা করেছে। এছাড়া থানা থেকেও সামান্য কিছু টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন।
৪০ বছর লাশ টেনেই জীবন চালিয়েছেন তিনি। আর এখন নিজেই জীবন্ত লাশ হয়ে জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকার ওষুধ লাগে। কোনোভাবেই জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তার অপারেশন করে পা কেটে ফেলতে বলেছেন। এতে দুই লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। অথচ তার সেই সামর্থ নেই।
তাঁর স্ত্রী বুলু খাতুন বলেন, প্রথম দিকে লাশ টেনে বাড়ি আসার পর অস্বস্তি লাগতো। বাড়ির কেউ তাঁর সাথে মিশতো না। এখন সয়ে গেছে। বর্তমানে ওসবের চেয়ে জীবন বাঁচানো দুস্কর হয়ে পড়েছে।
লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুজ্জামান রাজু বলেন, তিনি সদ্য থানায় যোগদান করেছেন। হাশেম আলী পুলিশের কাজে সহায়তা দিয়ে এসেছেন। সেবার ব্রত নিয়ে তিনি এই পেশার মাধ্যমে মানুষের উপকার করেছেন। তাঁর এ দুর্দিনে সকলের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাঁর পক্ষ থেকে যতটুকু করা সম্ভব তিনি সহযোগিতায় পদক্ষেপ নেবেন।
অসহায় হাশেম আলীর চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পুলিশ, প্রশাসনসহ সমাজের হৃদয়বান ও বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।