
আল কুরআনে ইসলামকে অনেক জায়গায় ‘দ্বীন’ প্রতিশব্দে উল্লেখ করা হয়েছে যার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাংলা পরিভাষা হচ্ছে ‘জীবনব্যবস্থা’। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা এই আয়াতটি নাযিল করেছেন, ‘আজকের এই দিনে তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি নিয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে একমাত্র দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা-আল মায়িদা: ৩)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইসলামকে শুধু পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ঘোষণা করেননি বরং সকল জীবনব্যবস্থার উপর ইসলামকে বিজয়ী করার ঘোষণাও দিয়েছেন। সুরা তাওবা-৩৩, সুরা ফাত্হ-২৮ ও সুরা সফ-৯ নং আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁর রাসুলদেরকে পাঠিয়েছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ যাতে তাঁরা সকল জীবনব্যবস্থা বা মতবাদের উপরে ইসলামকেই বিজয়ী করেন। যদিও কাফের-মুশরেকরা তা অপছন্দ করে।’ কোন বিপরীত শক্তির উপর বিজয়ী হওয়ার স্বাভাবিক দাবীই হলো একটি সর্বাত্মক আন্দোলন, একটি প্রাণান্তকর সংগ্রাম ও একটা সার্বিক বিপ্লবী পদক্ষেপ। সুতরাং আন্দোলন, সংগ্রাম, বিপ্লব প্রভৃতি শব্দ ইসলামের আলোচনা বা জ্ঞান গবেষণায় নতুন করে আমদানী করা কোন শব্দ নয়। ঈমানের সাথে, ইসলামের মূল প্রাণসত্তার সাথে এই শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে আছে।
আরবী ‘আল হারকাতুল ইসলামিয়া’র বাংলা প্রতিশব্দ ইসলামী আন্দোলন। আধুনিক আরবী ভাষায় তা রাজনৈতিক পরিভাষা হিসেবেই প্রচলিত। যদিও আল কুরআনে এর নিজস্ব একটি পরিভাষা রয়েছে এবং তা হচ্ছে ‘আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ অর্থ্যাৎ আল্লাহর পথে জিহাদ। এখানে ‘জিহাদ’ শব্দটি ‘আন্দোলন’ শব্দটি থেকে অনেক ব্যাপক ও গভীর অর্থ বহন করে। আরবী ‘জিহাদ’ শব্দটি এসেছে ‘জুহুদ’ শব্দ থেকে। যার অর্থ যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা, চূড়ান্ত প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর সাধনা প্রভৃতি। কুরআনিক পরিভাষায় ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র অর্থ আল্লাহর পথে চূড়ান্ত ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। সে অর্থে একটি দেশের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভৃতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে ইসলামী আদর্শের আলোকে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত প্রচেষ্টাকেই ইসলামী অন্দোলন বলা যেতে পারে।
জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা ইসলামী আন্দোলন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের স: প্রতি ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর নির্দেশ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল স:-ই আমাদেরকে দিয়েছেন এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণাও দিয়েছেন। এর অস্বীকারকারীর ঈমান থাকতে পারে না। আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলের স: দেখানো পথ বাদ দিয়ে কেউ অন্য কোন পথ-পন্থা অবলম্বন করা মানে কুফরী করা। আর কেউ বাহ্যিক আমল-আখলাকের মাধ্যমে নিজেকে পাক্কা ঈমানদার-মুসলিম দাবি করলো কিন্তু জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর কাজে শরীক হলো না কিংবা ইচ্ছাও পোষণ করলো না হাদীসের ভাষায় তার আচরণকে মুনাফিকী বলা হয়েছে, যার শাস্তি কুফরী থেকেও জঘন্য। মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রাসুল স: বলেন, যে ব্যক্তি মারা গেল, কিন্তু জিহাদের ময়দানে অবস্থান গ্রহণ করেনি কিংবা অন্তরে জিহাদের ইচ্ছাও পোষণ করেনি, সে মুনাফিকীর মৃত্যুবরণ করলো।
ইসলামের মূল স্তম্ভ যেমন নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন ও পরিপূর্ণ হক আদায়ের জন্যও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা বা খেলাফত ব্যবস্থা জারি থাকা আবশ্যক। আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলের স: সুন্নাহর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের মূল নেতৃত্বের আসনে ইসলামকে পৌঁছানো অবশ্যই প্রয়োজন। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব। রাসুলুল্লাহ স: এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা: আমাদেরকে তা অর্জন করে দেখিয়ে গেছেন। রাসুলুল্লাহর স: ইন্তেকালের পর খোলাফায়ে রাশেদার বত্রিশ বছরের শাসন ছিল ইসলামী ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। পরবর্তিতে রাজতান্ত্রিক পদ্ধতির খেলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। রাজতান্ত্রিক এই পদ্ধতিতে শাসকশ্রেণি ব্যক্তিগতভাবে ফাসেক-জুলুমবাজ হলেও খেলাফত পরিচালনায় সেখানে কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতিই অনুসরণ করা হতো। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয়ভাবে তাওহীদ বা আল্লাহর রবুবিয়্যাত প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় আলেম-ওলামাদের কমবেশি তত্ত্বাবধান ছিল। সেখানে খলীফারা ছিলেন বিশ্বের সকল মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক। এই খেলাফত ব্যবস্থা বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নামেমাত্র হলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশে জারি ছিল। যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সামজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তার দোষররা ধ্বংস করে ছাড়ে।
আজ খেলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আল্লাহর রবুবিয়্যাতের অনুপস্থিতিতে দেশে দেশে মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশি জুলুমের শিকার। মুসলিম দেশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভৌগলিক সীমারেখা ও জাতীয়তার নিগঢ়ে আজ আবদ্ধ। উম্মাহ্ কেন্দ্রীক বৃহত্তম ঐক্য চিন্তার পরিবর্তে সা¤্রাজ্যবাদী চক্রান্তের শিকার হয়ে নিজেদের মধ্যে ফের্কাবাজী, দলাদলি ও রক্তারক্তিতে লিপ্ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি বিগত প্রায় এক’শ বছরে মুসলমানদের যে পরিমাণ রক্ত ঝরিয়েছে, মুসলমানদের ভূমি দখল করেছে কিংবা ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুনের ক্ষতিসাধন করেছে তার বিবরণ বর্ণনাতীত। শুধু তাই নয় ইসলামী খেলাফত ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অমুসলিম জনপদেও মজলুমের কাতার দিন দিন ভারি হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার যাঁতাকল মানবিকতাবোধ কেড়ে নিয়ে মানুষকে শুধুমাত্র উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করেছে। কর্পোরেট কালচার ভোগবাদী ও আগ্রাসী মানসিকতার এমন এক এলিট শ্রেণি তৈরি করছে যারা তাবৎ দুনিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ছড়ি ঘুরাচ্ছে। ব্যবসায়িক কিংবা মতাদর্শিক স্বার্থে তারা দেশে দেশে যুদ্ধ-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ উস্কে দিচ্ছে। আক্রান্ত দেশ ও জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠন করছে।